যে সবজি গুলো আপনার ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজে আসবে !
আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক অপরূপ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে নাইকো শেষ- বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও বুড়িগঙ্গাবিধৌত বাংলার রূপ ও সৌন্দর্য সবই মনোমুগ্ধকর। প্রায় কয়েক শ’ ফলের সমারোহে সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ। কবি তাই যথার্থই বলেছেন- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।
খাদ্য ও পুষ্টি :
আমাদের খাদ্য গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কার্যক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যেকোনো খাবার খেয়ে পেট ভরানো যায়, কিন্তু তাতে দেহের চাহিদা মিটিয়ে সুস্থ থাকা যায় না। কাজেই প্রকৃত খাদ্য সম্বন্ধে আমাদের প্রত্যেকেরই ধারণা থাকা দরকার। বাংলাদেশে খাদ্যঘাটতির চেয়ে পুষ্টি সমস্যা অনেক বড় আকারে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মা ও শিশুরাই এর শিকার বেশি। এ দেশের খাদ্যঘাটতি পূরণের জন্য দানাজাতীয় (চাল, গম) খাদ্য উৎপাদনও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অথচ এ ধরনের খাবার ছাড়া শাকসবজি ও ফলমূলজাতীয় খাবারেরও যে অনেক ঘাটতি রয়েছে এবং এসব অতি জরুরি খাবারের অভাব যে কেবল ভাত দিয়ে পূরণ হয় না, তা আমরা তেমন বিবেচনা করি না। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে সুষম খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমরা মোটেই সচেতন নই। তাতে যারা পেটভরে দু’বেলা খেতে পায় না তারাই যে শুধু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তা নয়, সেই সাথে ধনীরাও অপুষ্টি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত নন। এমন অবস্থায় পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রচারণার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি করে দেখা দিয়েছে।
দেহের ক্ষয় পূরণ, পুষ্টিসাধন এবং দেহকে সুস্থ ও নীরোগ রাখার জন্য নানা ধরনের ফল-সবজি অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্য। এগুলো ছাড়া আমাদের সুষম খাদ্যের বিষয় চিন্তা করা যায় না। খাদ্যবিজ্ঞানীরা একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফল-সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে শাকপাতা ১১০ গ্রাম, ফুল-ফল-ডাঁটাজাতীয় সবজি ৮৫ গ্রাম, মূলজাতীয় ৮৫ গ্রাম ও ফল ১১০ গ্রাম ধরা হয়েছে।
ফল ও সবজি পুষ্টিতে সমৃদ্ধ হলেও সংরক্ষণ, খাবার পরিবেশন ও ত্রুটিপূর্ণ রান্নার কারণে এসব খাবারের প্রকৃত গুণাগুণ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে থাকি। তাজা অবস্থায় ফল-সবজি খেলে তাতে খাদ্যমান বেশি পাওয়া যায়। প্রায় সব রকম ফলে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। শাকসবজিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ থাকে, তবে রান্না করার সময় তাপে প্রায় ৮০ শতাংশ ভিটামিন ‘সি’ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই সালাদ হিসেবে শাকসবজি খেলে ভিটমিন ‘সি’সহ আরো কিছু উপাদানের (ভিটামিন ও মিনারেলস) পুরো উপকার পাওয়া যায়। তবে যাদের সবজি কাঁচা খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে তাদের হালকা সেদ্ধ করে খাওয়াই উত্তম।
আপেল, নাশপাতি, পেয়ারা, শসা ইত্যাদি ধরনের ফলের ছিলকা বা ওপরের খোসা আমরা অনেকেই ফেলে দেই। তাতে অনেক খাদ্যমান অপচয় হয়। ফল-সবজি উভয় ক্ষেত্রে সম্ভব হলে খোসা না ফেলাই ভালো। বেশি পাকা ফলে খাদ্যমান কমে যায়। যেমন- পাকা পেঁপে থেকে আধা পাকা পেঁপে বেশি পুষ্টিমানসম্পন্ন। তা ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। ফল-সবজি আগেই ভালোভাবে ধুয়ে কাটা উচিত। আগে কেটে পরে ধোয়া হলে পানির সাথে অনেক খাদ্য উপাদান বা ভিটামিন বের হয়ে যায়।
অনেকে করলার তিতা স্বাদ কমানোর জন্য সেদ্ধ করে পানি ফেলে দেন। কোনোমতেই এটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সবজি কাটার আগে হাত, বাসন ও বঁটি (কাটার যন্ত্র) ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া প্রয়োজন। সবজি কুচি কুচি করে কাটলে পুষ্টিমানের অপচয় হয়, তাই তরকারির টুকরোগুলো বড় রাখা প্রয়োজন।
অনেকের ধারণা, বেশি তেল-মসলা দিলেই রান্না ভালো হয়। অথচ কম তেল-মসলা ও কম সেদ্ধ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। পাতিলের মুখ খোলা রেখে রান্না করা ঠিক নয়, পরিমিত তেল-মসলা দিয়ে একেবারে রান্না চড়িয়ে ভালোভাবে ঢেকে রান্না করতে পারলে ভালো।
অবশ্য চর্বিজাতীয় খাদ্য ঢেকে রান্না করা ঠিক নয়। রান্নার পরপরই গরম অবস্থায় খাওয়া উত্তম। পরে খেলে অবশ্যই খাদ্য গরম করে খাওয়া উচিত। চাল-ডালসহ নানা রকম শাকসবজি দিয়ে খিচুড়ি পাক করে খাওয়া স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অতি উত্তম। এতে পুষ্টিমান রক্ষা, সময় উভয়ই বাঁচে অথচ খাবার হিসেবেও চমৎকার।
ফল আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ, খাদ্য চাহিদা পূরণ, পুষ্টি সরবরাহ, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বহুমাত্রিক অবদানে ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ফল দেহে আনে বল, মনে আনে প্রশান্তি; ভিটামিন ও মিনারেলসের অন্যতম উৎস। প্রতিদিন একজন লোকের ১৫০-২০০ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। আমাদের দেশে বর্তমানে মাথাপিছু ফলের উৎপাদন প্রায় ৭০-৭৫ গ্রাম, যা চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল, সেখানে ভারতে উৎপাদন ১১১ গ্রাম, ফিলিপাইনে উৎপাদন হয় ১২৩ গ্রাম, থাইল্যান্ডে উৎপাদন হয় ২৮৭ গ্রাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রচলিত ফলের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া অপ্রচলিত ফল যেমন- আতা, শরিফা, সফেদা, ডেউয়া, গাব, কাউফল, ক্ষুদিজাম, লটকন ইত্যাদি ফলের আবাদ বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ফলভাণ্ডার। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ প্রকারের ফল জন্মে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মতে, বিগত ২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশের প্রধান ফলগুলো যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, আপেল কুল, আনারস, নারিকেলসহ সব ফলের চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ছিল মোট সাত লাখ ২০ হাজার হেক্টর এবং এতে মোট ফলের উৎপাদন প্রায় ১১০ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিকটন। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে বছরে প্রায় ৩৩ শতাংশ ফল নষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যেকের দৈনিক ১৫০ গ্রাম হিসেবে বাৎসরিক ফলের চাহিদা প্রায় ৭৮ লাখ মেট্রিকটন। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে ফল নষ্ট হওয়াতে প্রতি বছর প্রায় ২০-৩০ লাখ টন ফল আমদানি করতে হয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রত্যেকের দৈনিক ১৫০ গ্রাম হিসেবে বর্তমানে আমাদের বছরে ৪৮-৫০ কেজি ফল খাওয়া উচিত, কিন্তু খাচ্ছি মাত্র ২৮-৩০ কেজি। তবে আমরা তিন বছর ধরে রসালো ফল, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ইউরোপসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে রফতানি করছি।
বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব ফল উৎপাদন হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয় বছরের চার-পাঁচ মাসে (এপ্রিল-জুলাই), বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ বছরের সাত-আট মাসে (আগস্ট-ফেব্রুয়ারি)। আমাদের দেশে ফলের দোকানে বিভিন্ন জাতের বিদেশী ফলের সমাহার সারা বছর দেখা যায়। তবে এসব বিদেশী ফলের ভিড়ে আমাদের চিরচেনা ক্ষুদেজাম, গোলাপজাম, ডেউয়া, গাব, লটকন, আতা, কদবেল প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছে। অথচ রঙ, রূপবৈচিত্র্যে, পুষ্টি ও রসনায় এসব দেশীয় ফল অনেক সমৃদ্ধ। এ জন্য এসব দেশীয় ফলের চাষ বৃদ্ধির জন্য আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বর্তমানে ফলচাষ সম্প্রসারণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সিলেটের কমলা এখন পাহাড়ের তিন জেলায় চাষ হচ্ছে। গ্রীষ্মকালের আনারস এখন প্রায় সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। থাই পেয়ারা, আপেল কুলের উৎপাদনও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও সুস্থভাবে বাঁচার তাগিদে দানাজাতীয় শস্যের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ঘটিয়ে পুষ্টিকর ফল প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অবশ্যই সংযোজন করতে হবে।
সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একজন কর্মক্ষম মহিলা ও পুরুষের দৈনিক যথাক্রমে ২৪০০ ও ২৮০০ ক্যালোরি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এই খাদ্য পূরণের জন্য পুর্ষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একজন মানুষ প্রতিদিন ২৫০-৩০০ গ্রাম চাল, আমিষ ১৫০-২০০ গ্রাম (মাছ/গোশত), ডিম একটি, দুধ ২৫০ গ্রাম, চর্বি/তেল ৩৫-৪০ গ্রাম, সবজি ২৫০ গ্রাম, ফল ১৫০-২০০ গ্রাম, আঁশজাতীয় খাবার (মটর, ডাল, শিম, ত্বকসহ ফলমূল, বাদাম ইত্যাদি) ১০০ গ্রাম এবং পরিমাণমতো পানি (কমপক্ষে ২.৫ লিটার/১০-১২ গ্লাস) খাওয়া উচিত। গবেষণায় দেখা গেছে, মানবদেহের সুষ্ঠু গঠন ও রোগ প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, লবণ ও পানিসহ প্রায় ৪০ রকম বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান জরুরি।
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রথমেই চালের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ভাত কম খাওয়ার একটি পদ্ধতি আছে। চীন, জাপান ও কোরিয়ানরা প্রথমে হরেকরকম সবজি দিয়ে খাওয়া শুরু করে। তারপর দানাদার খাদ্য রুটি অথবা ভাত খায়, অতঃপর ফল বা ফলের রস দিয়ে শেষ করে। আমরা অন্তত এক গ্লাস পানি দিয়ে খাবার শুরু করেতে পারি। আমরা অনায়াসে সেটা অভ্যাস করতে পারি। এতে অবশ্যই ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমে যাবে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। প্রয়োজন শুধু একটু অভ্যাসের পরিবর্তন। সুতরাং সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ও খাদ্য নিরাপত্তায় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি।
আমাদের অবশ্যই সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সচেতন হতে হবে। এতে আমরা শারীরিকভাবে ভালো থাকব, পুষ্টিহীনতায় ভুগব না এবং ডাক্তারের কাছে তেমন একটা যেতে হবে না। যেমন যেতে হয় না চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য উন্নত দেশের লোকদের।
ভেজাল খাবারের প্রভাব :
অপরিকল্পিত বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পোকামাকড়, রোগবালাইয়ের প্রাকৃতিক শত্রু বন্ধু পোকা ধ্বংস হচ্ছে। শত্রু পোকার বালাইনাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফসলে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ও মাছে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক (ফর্মালিন, কার্বাইড) মেশানোর ফলস্বরূপ মানবদেহে সৃষ্টি হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সার, ব্রেন ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার ইত্যাদি। খাদ্যে ভেজালের কারণে গ্যাসট্রিক, আলসার, হৃদরোগ, অন্ধত্ব, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, স্নায়ুরোগসহ প্রভৃতি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী আজ অসহায় হয়ে পড়েছে। বাতাসে সিসা, পানিতে আর্সেনিক, চালে ক্যাডমিয়াম, মাছে ফরমালিন, ফলে কার্বাইড, ফলের রসে বিভিন্ন ক্ষতিকারক গার্মেন্ট রঙ, মুরগির গোশতে ক্রোমিয়াম সব দিকে বিষ আর বিষ- আমরা যাবো কোথায়? এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, খাদ্য ভেজালের কারণে শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে ৭৯ লাখ মানুষ মারা যায়।