শীতের বিচিত্র পিঠা-পুলি এক আচার্য নেয়ামত !

শীতের বিচিত্র পিঠা-পুলি এক আচার্য নেয়ামত !

ধর্ম ও জীবন

শীতের বিচিত্র পিঠা-পুলি এক আচার্য নেয়ামত !

প্রকৃতিতে বইছে শীতের সমীরণ। কুহেলিঘেরা সকাল মনে হয় শ্বেত হিমালয়। পিচঢালা সরু পথের দু-ধারে সারি সারি খেজুর গাছে ঝুলানো রসের হাঁড়ি সত্যিই চমৎকার দেখায়। জিবের জল জানান দেয় খাওয়ার আগ্রহ। গ্রামগঞ্জের চিরচেনা রীতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে খেজুর রস দিয়ে শুরু হয় পৌষ-পার্বণের রকমারি পিঠার আয়োজন। মূলত হেমন্তের নতুন ধান ঘরে আসার পরপরই গ্রামগঞ্জে শুরু হয় পিঠাপুলির এ মহোৎসব। চলে শীতের শেষ সময় পর্যন্ত। এ যেন মহান আল্লাহ তায়ালার অনন্য নেয়ামত। তাঁর হুকুমে আসমান থেকে বর্ষিত পানি দ্বারা উৎপাদিত হয় আতপ চাল।

অন্যদিকে খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় সুমিষ্ট রস। গ্রামের বৌ-ঝিরা আতপ চাল গুঁড়া করে খেজুর রস দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরনের পিঠা। সে পিঠা খেয়ে তৃপ্ত হয় মন। নিমিষেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে শুকরিয়া ধ্বনি ” আলহামদুলিল্লাহ”।

পিঠার অন্যতম উপাদান চালের গুঁড়া হলেও এর সঙ্গে লাগে গুড়, চিনি, নারকেল, ক্ষীরসহ নানা উপকরণ। সকালবেলা বাড়িতে বাড়িতে খেজুরের রসে ভেজানো পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। এ সময় গ্রামে বেড়াতে আসেন শহুরে নাইয়র। জামাই-ঝি, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই মিলে পিঠা খাওয়ার আসরটা জমজমাট হয়ে ওঠে। হাসি-আনন্দে প্রাণবন্ত হয় চারপাশের পরিবেশ। গ্রামগঞ্জে বহুল প্রচলিত কিছু পিঠা প্রস্তুত প্রণালিসহ নিম্নে তুলে ধরা হলো:-

চিতই পিঠা : বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অতি জনপ্রিয় একটি পিঠা এটি। দেখতে গোল ও চ্যাপ্টা ধরনের হয়। চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে গরম তাওয়ায় ভেজে এই পিঠা তৈরি হয়। এটি গুড় বা গোশতের ঝোল দিয়ে খাওয়া হয়। দুধ, নারকেল আর গুড়ের তৈরি সিরায় ভিজিয়েও খাওয়া হয়। শীতকালে প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয় এ পিঠা।
ভাপা পিঠা : শীতকালীন বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী পিঠা এটি। চালের গুঁড়া দিয়ে জলীয়বাষ্পের আঁচে তৈরি করা হয়। ভেতরে দেওয়া হয় গুড় আর নারকেল। ঐতিহ্যগতভাবে এটি একটি গ্রামীণ নাশতা হলেও বিংশ শতকের শেষভাগে প্রধানত শহরে আসা শুরু করে। রাস্তাঘাটেও আজকাল ভাপা পিঠা কিনতে পাওয়া যায়। এটি বানাতে প্রথমে চালের গুঁড়ায় সামান্য লবণ ও পানি মিশিয়ে মেখে নিতে হয়। একটি মাটির পাতিল আধা ইঞ্চি গোল ফুটো করে আঠা দিয়ে পাতিলের মুখ আটকে নিতে হয়। পাতিলের অর্ধেক পানি দিয়ে চুলায় বসিয়ে পানি ফুটাতে হয়। ছোট একটি বাটিতে প্রথমে মাখানো চালের গুঁড়া ও মাঝখানে নারিকেল দিয়ে বাটি ভর্তি করে বাটির মুখ পাতলা কাপড় দিয়ে মুড়ে ফুটন্ত হাঁড়ির ছিদ্রে বসিয়ে দুই মিনিট সিদ্ধ করতে হয়। তারপর গরম গরম পরিবেশন করা যায়।

ভাপা পিঠা: এটি একটি মুখরোচক পিঠা। শীতকালে এ পিঠাতো গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হয়। আর শহরে বিক্রি হয় রাস্তার মোড়ে-মোড়ে। এর প্রধান উপাদান চালের গুঁড়া। মিষ্টি করার জন্য এতে দেয়া হয় গুড়। নারকেলের শাঁস ব্যবহার করে এর স্বাদ বাড়ানো হয়। চালের গুড়ায় সামান্য লবণ ও পানি মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। তারপর মাখানো চালের গুঁড়াকে চালুনি দিয়ে চেলে নেয়া হয়। এরপর নারিকেলের চাঁছা এবং গুড় মিশিয়ে জ্বাল দিতে হয়। এটি তৈরি করা অত্যন্ত কৌশলের ব্যাপার। জলীয় বাষ্পের আঁচের সাহায্যে এ পিঠা তৈরি করা হয়। তাই এর স্বাদে আসে অনন্যতা।

দুধপুলি : স্বাদে ভরপুর পুলিপিঠা গ্রামবাংলায় বেশ জনপ্রিয়। শীতকালে এর মধুর ঘ্রাণে ম-ম করে চারদিক। এই পিঠার ভেতরে পুরের জন্য দেড় কাপ নারকেল কোরানো দিতে হয়। বাকি নারকেলের সঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় চামচ চিনি দিয়ে ফ্রাইপ্যানে সাত থেকে আট মিনিট ভেজে নিতে হয়। দুধের সঙ্গে গুঁড়াদুধ, চিনি আর এলাচ মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। পিঠা বানানো হতে হতে দুধ খুব সুন্দর জ্বাল হয়ে হালকা রং হবে। অন্য পাতিলে পানির সঙ্গে লবণ এবং ঘি দিয়ে গরম করতে হবে। ফুটানো পানির সঙ্গে চালের গুঁড়া ও ময়দা দিয়ে খুব ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে চুলা বন্ধ করে দিয়ে খামির করতে হবে।
রুটি বানানোর পিঁড়িতে গরম গরম খামির খুব ভালো করে মথে নিতে হয়। এর পর খামিরটা ১০ ভাগ করতে হবে। একেকটি ভাগ দিয়ে ছোট ছোট রুটি বেলে অথবা হাত দিয়ে চেপে পাতলা করে ভেতরে নারিকেলর পুর দিয়ে কুলিপিঠা তৈরি করতে হবে। এভাবে সব পিঠা তৈরি করে নিতে হবে। এখন বানানো কুলিপিঠা ফুটিয়ে রাখা দুধের মধ্যে দিয়ে চুলার আঁচ কম রেখে ১০ মিনিট রান্না করতে হবে। হাঁড়ি আস্তে ঝাঁকিয়ে পিঠার সঙ্গে দুধ মিশিয়ে নিতে হয়।

তেলের পিঠা : তেলে ভেজে তৈরি করা হয় বলে এর নাম তেলের পিঠা। খেতে খুবই সুস্বাদু। শীতকাল ছাড়াও সারা বছর তৈরি করা হয় এটি। এই পিঠা বানানোর জন্য একটি বাটিতে চালের গুঁড়া এবং ময়দা নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার গুঁড়া বা চিনি দিয়ে ভালো করে মাখতে হবে। অল্প পরিমাণে উষ্ণ গরম পানি দিয়ে কেক মিশ্রণের মতো মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এবার কড়াইয়ে তেল গরম করুন। তেল পর্যাপ্ত গরম হলেই মিশ্রণ তেলে ছাড়–ন। একটি বড় গোল চামচ নিয়ে মিশ্রণটি নেড়ে এক চামচ পরিমাণ মিশ্রণ তেলে ছাড়–ন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পিঠাটি ফুলে উঠবে। ফুলে উঠলে পিঠাটি উল্টে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভেজে পরিবেশন করতে পারেন।

পাটিসাপটা : বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে জনপ্রিয় পিঠা এটি। ময়দা, চালের গুঁড়া, চিনি, দুধ, ক্ষীর, নারকেল ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। পাটিসাপটার পুর হিসেবে নারকেল এবং ক্ষীর দুইই ব্যবহার করা হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘পুঁই মাচা’তে পাটিসাপটা পিঠার উল্লেখ আছে। এটি তৈরির জন্য ঝুনো নারকেলের কুরা, গুড় বা চিনি দিয়ে ক্ষীর পাক করে পুর বানিয়ে নিতে হবে। ময়দায় দুধ, পানি আর একটু মিহি চালের গুঁড়া মিশিয়ে ম- পাকিয়ে গোল গোল লেচি করে নিতে হবে। এবার লেচিগুলো ছোট ছোট গোল আকারে বেলে, অল্প পুর ভেতরে দিয়ে পাটির মতো পাট করে নিতে হবে। শেষ পাটে লবঙ্গ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। এখন একে পাট করা লম্বা আকারের দেখা যাবে। এরপর একে ঘিয়ে ভেজে নিয়ে চিনির রসে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে। রস থেকে তোলার পর পাটিসাপটা পরিবেশন করা যাবে।

Riport: Sabbir

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.