মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নিয়ে ইদুর বিড়াল খেলা;
মন্ত্রী চেয়েও দখলকারীরা কি ক্ষমতাধর?
বিশেষ প্রতিনিধি: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে পাক বাহিনীর দোসর রাজাকারদের পরাস্ত করে ৯ মাসে দেশকে স্বাধীন করে ছিনিয়ে আনেন লাল-সবুজের পতাকা। তারই ধারাবাহিকতায় কপিলমুনির মুক্তিযোদ্ধারা ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ১৫৬ জন রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে কপিলমুনিকে কলঙ্কমুক্ত করেন।
অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে আর কপিলমুনির যুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য আগামী প্রজন্ম তথা বাংলাদেশের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বাহাদুর সহ দুই জন প্রভাবশালী সচিব ও এলাকার সংসদ সদস্য সহ সুধীজনের প্রচেষ্টায় কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে সরকারি খাস জায়গায়
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও কমপ্লেক্স নির্মাণ নিয়ে ইদুর বিড়াল খেলা শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তিরা। সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে তাদের তালবাহানা, অবৈধ দখলদারদের পক্ষে একটি মহলের সরাসরি ভূমিকা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে চলছে কমপ্লেক্সের জায়গা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন আর দখলকারীদের মধ্যে ইদুর বিড়াল খেলা। রীতিমতো জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের মন্তব্য এমনই মন্ত্রী চেয়ে কি দখলদাররা ক্ষমতাধর? নাকি রায় সাহেবের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলতে বা মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বিজড়িত শক্ত রাজাকার ঘাঁটিতে ঐসময় হাজারো মানুষের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্নকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে ইতিহাসের পাতা থেকে ঐতিহাসিক কপিলমুনি যুদ্ধের নানা নিদর্শন মুছে ফেলতে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কিনা সেটি ভেবে দেখা জরুরী। তেমনই সরকারি খাস জায়গা উদ্ধারে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন। তা না হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধা তথা রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেনা।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষযক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। এর কয়েক দিন পর জায়গাটি নিজেদের মালিকানাধীন দাবি করে সেখানে প্রাচীর ও কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নেয় স্থানীয় অমিত ও অভিজিত সাধু গং। এছাড়া পাশে প্রাচীর দিয়ে অবৈধভাবে দখলে নেয় এক দরিদ্র পরিবারের ক্রয়কৃত রেকর্ডীয় সম্পত্তি।
বহুলালোচিত জায়গাটি বে-দখলের খবরে গত ১৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তৎকালীণ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলমের নেতৃত্বে কাটাতারের বেড়া অপসারণপূর্বক ঐ সম্পত্তির অবৈধ দখলমুক্ত করা হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও দখল করা হয়েছে বলে মেীখিকভাবে সাংবাদিকদের জানান।
অথচ মজার ব্যাপার প্রভাবশালী ভূমিদস্যু অভিজিত সাধুর অনুকুলে অবৈধ দখল থেকে যায় দরিদ্র পরিবারের ক্রয়কৃত রেকর্ডী সম্পত্তি। যা নাছিরপুর মৌজা এস.এ খতিয়ান ১৯৩, দাগ ৪২৬/৫৯৩। এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর’২০ ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবসে নদ ভরাটী জমিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন। তারও আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলম, স্থানীয় ইউএলএ ও হাসমত, উপজেলা সার্ভেয়ার মো. কাওছার আলীসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থেকে কমপ্লেক্সের স্থান নির্ধারণ ও জরিপকার্য সম্পন্ন করেন।
তবে সাবেক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আরাফাতুল আলমের বদলিকালীন সময়ে আধুনিক কপিলমুনির রূপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ভ্রাতা কুঞ্জবিহারী সাধুর ওয়ারেশরা ফের ঐ সম্পত্তি তাদের বলে দাবি করে পুনরায় কাটাতারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নিয়ে নেয়। অথচ কুঞ্জ বিহারীর বড় ছেলে নারায়ন সাধু ভারতে অবস্থান করায় দেশে ৪ পুত্র ওয়ারেশ দাবী করে বড় সৎ ভায়ের জমি আত্তসাৎ করছে। এমন পরিস্থিতিতে কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০১৩ সালে কপোতাক্ষের চরভরাটি নাছিরপুর মৌজার খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগের বিস্তীর্ণ সম্পত্তির মধ্য থেকে স্থানীয় জনৈকা মালঞ্চ বিবি নামের এক গৃহ ও ভূমিহীন মহিলা মিস কেস নং-৮৭৬/১২-১৩ মাধ্যমে ১০শতক খাসজমির ডিসিআর প্রাপ্ত হন। তবে বরাবরই ডিসিআর প্রাপ্ত হয়েও ঐ সম্পত্তি দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।
এ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা-পাল্টা মামলারও ঘটনা ঘটে। বিষয়টি অবহিতপূর্বক তখন ওই মহিলার জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐবছরে তিনি ৩০ জানুয়ারি ২০১৮, ০৫.৪৪.৪৭০০.০৩১.৩৩.০০১.১৮-১৪৫৫নং স্মারকে দখল ও সীমানা বুঝে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাইকগাছাকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মহিলা বন্দোবস্তকৃত সম্পত্তির দখল নিতে গেলেও বাঁধার মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হন। এরপর সর্বশেষ গত বছরের ৫ মে পুনর্দখল বুঝে পেতে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি আবেদন করলে ইউএনও ৬ মে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে কপিলমুনি ভূমি অফিসের ইউএলও এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাবুল হোসেনকে নির্দেশ দেন। যার প্রাপ্তি নং-২৯৪।
সর্বশেষ ইউএনও অনুমতিতে স্থানীয় ইউএলও-স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় ১৪মে সকালে কপোতাক্ষ তীরের বন্দোবস্তপ্রাপ্ত খাসজমিতে তৃতীয় দফায় ঘর বাঁধতে গিয়েও দখলদারদের বাধার সম্মুখীন হন। ঐ ঘটনায় ১৬মে পাইকগাছা বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্থানীয় দখলদারদের একজন তপন কুমার সাধুর ছেলে অমিত সাধু ওরফে শান্ত বাদী হয়ে স্থানীয় ইউএলএও মো. জাকির হোসেন ও স্থানীয় এক সাংবাদিক তপন পাল সহ কয়েকজনকে আসামী করে একটি মামলাও করেন। যা পিবিআই তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যর মধ্যস্থতায় মহিলাকে অন্যত্র পূণর্বাসন করলে ফের ঐ সম্পত্তির দখলে যান অমিত ওরফে শান্ত সাধু গং।
এরপর কপিলমুনি মুক্ত দিবসকে সামনে রেখে সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিলে নড়ে চড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রশাসনের দফায় দফায় বৈঠকে ঐএলাকা নির্ধারিত স্থান বলে চিহ্নিত ও কয়েক দফায় সার্ভেয়াররা জরিপ করে সীমানায় লাল পতাকা টানিয়ে দেন। এরপর ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। তবে এরপরও বন্ধ হয়নি এর দখল কার্যক্রম। সম্প্রতি তারা ফের দরিদ্র পরিবারে ব্যক্তিগত ও সারকারি খাস ভিত্তিপ্রস্তরসহ গোটা এলাকায় কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। আর তুড়ি মেরে বুঝাতে চাচ্ছে আমরা মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর! (চলবে)