৯ লাখ হেক্টর জমির ধান নিয়ে চিন্তিত হাওরবাসী !
আর মাত্র এক মাস পরেই কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে হাজারো কৃষকের সারা বছরের একমাত্র সোনার ফসল বোরো জমির ধান কাটতে শুরু করবে। কৃষকেরা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এবারও প্রায় নয় লাখ হেক্টর বোরো জমিতে অনেক আশায় বুক বেঁধে রোদে পুড়ে হাওরজুড়ে চাষাবাদ করেছেন। এখন বোরো জমিতে তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাতদিন পরিশ্রম করছেন। কিন্তু ফসল হারানোর শঙ্কাও পিছু ছাড়ছে না কৃষকদের। কারণ গত বছর চৈত্রের পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যার মতো আবারও সব হারিয়ে নিশ্বঃ হয়ে যাবে না তো ? নতুন ধানে ঘুচাতে পারবে কি দুঃখ, ফুটবে কৃষকের মুখে হাসি। গোলায় উঠবে কি সারা বছরের খোরাক এ কষ্টের সোনার ফসল। পারবে কি সুদে আনা ঋণ পরিশোধ করতে? এ সব নানান প্রশ্ন মনে নিয়ে চিন্তাই রাতদিন ঘুর পাকাচ্ছে হাওরের অসহায় সাধারণ কৃষকদের মাঝে। ঘুম নেই দুটি চোখে ফসল হারানো সেই ভয়ে। তবে কৃষক আশাবাদী, এবার সোনালি ধানে ঘুরে দাঁড়াবেন তারা। সরকারি কর্মকর্তারাও শোনাচ্ছেন আশার কথা। বন্যা যদি এসেও যায়, তাহলে তা মোকাবেলা করে ফসল ঘরে তোলার কৌশলও বলে দেওয়া হয়েছে কৃষকদের।
শীতের শুরুতে হাওরের জমি থেকে পানি সরতে থাকে। বিস্তীর্ণ জলাভূমি হয়ে ওঠে বোরো ধান উৎপাদনের সবচেয়ে জুতসই জমি। হাজার হাজার একরের এই বিস্তীর্ণ জমি চারা ধানগাছের সবুজ পাতায় ভরে ওঠে। যেদিকেই চোখ যায়, কেবল সবুজের সমারোহ। মাঠের এই দিগন্ত বিস্তৃত ঘন সবুজ সময়ের ব্যবধানে লাখ লাখ টন বোরো ধানের আগাম বার্তা ঘোষণা করে। গত কয়েক মাস আগে যেসব হাওর বন্যায় প্লাবিত ছিল, এখন সেখানে সবুজের বান ডেকেছে। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় ধান গাছের সবুজে সম্ভাবনার দোল উঠেছে। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতে বয়ে যাওয়া দামাল হাওয়ায় দুলছে কৃষকের স্বপ্ন। গোলায় নতুন ধান তুলে ঘুচাবে অতীতের সব দুঃখ-কষ্ট, মুক্ত হবে মাথা ভরা ঋণের বোঝা থেকে। মুখে ফুটবে কৃষকের কষ্টের হাসি। আবার ভাবছে হড়কা বানে হাওরের নয় লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান বিলীন হয়ে যাবে না তো!
গত বোরো মৌসুমে বন্যায় ফসল হারানোর ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন হাওরের সব শ্রেণির কৃষক। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, অন্যদিকে তা মোকাবেলায় বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম এ দুইয়ে হাওরবেষ্টিত জনপদের মানুষ জীবিকার প্রধান অবলম্বন বহু কষ্টে উৎপাদিত ধান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তবে সরকারের তাৎক্ষণিক প্রণোদনা ও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে এবার আশায় বুক বেঁধেছেন কৃষকরা। এ বছর হাওরে ফসলরক্ষার জন্য সরকারী উদ্যোগে ৮টি উপজেলায় মোট ৯টি হাওরে দুইশত কিলোমিটার কাচা বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। যা চার ফুট উচ্চতা ও ২৫ থেকে ৩০ ফুট প্রস্ত হচ্ছে বাঁধগুলো। তাছাড়া ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হবে ২০টি স্লুইসগেইট।
সেই আশাকে পুঁজি করে প্রাণান্ত চেষ্টায় এ মৌসুমে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে হাওরের কৃষকেরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত বালাই না হলে দেশের হাওর অঞ্চল সারাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে এবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সম্প্রতি হাওরের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বোরো ধান গাছে শীষ বেরিয়েছে। সারা হাওরে ধানের চারার ব্যাপক সমারোহ দেখা যায়। ঝিরিঝিরি হাওয়ায় কবিতার পংউক্তির মতো দোল দিয়ে যাচ্ছে ধানগাছের সবুজ পাতারা। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। বোরো মৌসুমের এই সময়কে হাওরের কৃষকদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা বুননের কালপর্ব বলা যায়।
সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে ইটনা উপজেলার পূর্বগ্রাম, লাইমপাশা, বাদলা, থানেশ্বর, মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া, চারিগ্রাম, ঢাকি, মহিষাকান্দি; অষ্টগ্রাম উপজেলার কাস্তুল, দেওঘর, বাংগালপাড়া ও আদমপুর এবং নিকলী উপজেলার ছেত্রা, ছাতিরচর, সিংপুর, দামপাড়া ও গুরুই এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা হয়।
তারা জানান, গত মৌসুমে ফসল হারিয়ে দুর্গতির সীমা ছিল না। সরকারি প্রণোদনা এবং পাশাপাশি ধারকর্জ করে কোনোরকমে টিকে আছেন তারা। আগের বারের কষ্টের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এ মৌসুমে কোনো জমি অনাবাদি না রাখতে প্রতিজ্ঞতাবদ্ধ ছিলেন তারা। ফসল উৎপাদনের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
এলাকার ধনাঢ্য কৃষকরা জানান, গত বছরের আগাম বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে তারা এবার দাদন নিয়েও জমি চাষ করছেন। তাদের আশা, যদি সময়মতো সেচ, সার ও কীটনাশক পাওয়া যায়, তাহলে এ বছর গত মৌসুমের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন তারা। একদিকে স্বপ্নে বুক বাঁধলেও অন্যদিকে এবারও কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের চাপা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার আতঙ্কে আছেন তারা।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হাওরবেষ্টিত জেলাগুলোতে এবার নয় লাখ ১৫ হাজার ৯২৪ হেক্টর জমিতে বোরা ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলায় এক লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর, সুনামগঞ্জ জেলায় দুই লাখ ২৪ হাজার, নেত্রকোনা জেলায় এক লাখ ৮২ হাজার ৪০০, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এক লাখ সাত হাজার ৫৫২, সিলেট জেলায় ৭৪ হাজার ১২০, মৌলভীবাজার জেলায় ৫২ হাজার ৩৫২ ও হবিগঞ্জ জেলায় এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৩৫ লাখ ২৬ হাজার ৩০৭ টন চাল।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, বোরো আবাদে এবার কিষান-কিষানিরা দলবেঁধে মাঠে নেমেছেন। তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে তাদের আশা পূরণ হবে। এছাড়া কখন কী করতে হবে, তা নিয়ে কৃষি বিভাগের ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সব ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, অর্থাৎ বন্যা দেখা দিলে প্রয়োজনে আধা-পাকা এবং খাওয়ার উপযোগী ধান কেটে নেওয়ার কৌশলও বলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যদি আগাম বন্যা হয়, তাহলে তা প্রথমে সুনামগঞ্জে দেখা দেয় এবং দু-তিন দিন পর কিশোরগঞ্জ হাওরে ঢলের পানি আসা শুরু করে। এবারও যদি এমন কিছু হয়েই পড়ে, তাহলে মধ্যের দু-তিন দিনে দেশি প্রযুক্তির মাধ্যমে তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হবে। আশা করি, এবার হাওরের কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। ধান ঘরে তুলতে পারলে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে।