দুধ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ খাবার!khulnatv

দুধ : পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ খাবার!

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আমরা সবাই জানি- মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আল্লাহ সুবহানুতায়ালার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। মুসা (আ.) একবার জানতে চাইলেন- আল্লাহ সুবহানুতায়ালা যদি কিছু খেতেন, তবে সেটি কোন খাবার হতো? জবাবে আল্লাহ সুবহানুতায়ালা বলেছিলেন, আমি তো জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। তবে আমার কিছু খাওয়ার প্রয়োজন হলে সেটি হতো দুধ!

সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ দুধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানে। দুধ এমন একটি সুষম খাবার, যেটিতে সকল খাদ্য উপাদানের (আয়রন আর ভিটামিন সি ব্যতীত) উপস্থিতি রয়েছে। এমন পুষ্টিকর খাবার আর দ্বিতীয়টি নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবদেহে যে খাবারের প্রয়োজন কখনো ফুরোয় না, সেটি হলো দুধ। এটি শিশুদের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিকর আর বৃদ্ধ ও রোগীদের জন্য সবচেয়ে সহজপাচ্য খাবার।

দুধ শিশুদের শরীরের হাড় মজবুত করে, তাদেরকে লম্বা করে। শরীরের মৃত কোষগুলোকে দূর করে, বাচ্চাদেরকে রিকেট রোগ থেকে দূরে রাখে। দুধ শিশুদের দাঁত মজবুত করে। কারণ দুধে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ সোডিয়াম ও ফসফরাস। আর খুব সহজেই এটা হজম হয়। দুধে খাদ্যের প্রায় সবগুলো গুণ যেমন : শর্করা, আমিষ, চর্বি, খনিজ ও ভিটামিন পাওয়া যায়। এছাড়াও মিনারেলের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম।

কোনো মা যদি তাঁর সন্তানকে দুধ দিতে ব্যর্থ হন, তখন বিকল্প হিসেবে গরুর দুধ পান করানো যায়। তবে মনে রাখতে হবে- অন্য কোনো প্রাণীর দুধ মায়ের দুধের বিকল্প হতে পারে না। শিশুর পুষ্টির জন্য মায়ের দুধই সেরা। পবিত্র কোরআনে ২নং সুরা বাকারা-এর ২৩৩নং আয়াতে পরিষ্কার উল্লেখ আছে : মায়েরা তাঁদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান করাবেন।

দুধ আল্লাহ সুবহানুতালার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য অপূর্ব উপহার! পবিত্র কুরআনের ১৬নং সুরা আল নাহল-এর ৬৬নং আয়াত হচ্ছে : অবশ্যই (গৃহপালিত) চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে তোমাদের জন্যে শিক্ষা রয়েছে। ওগুলোর উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে তোমাদেরকে আমি পান করাই বিশুদ্ধ দুগ্ধ, যা পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু। শুধু তাই নয়, দুধ হবে একটি স্বর্গীয় খাবার। ৪৭নং সুরা মুহাম্মদ-এর ১৫নং আয়াতে বলা হয়েছে : সাবধানিদেরকে যে জান্নতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত হলো সেখানে থাকবে নির্মল পানির নহর, আছে দুধের নহর, যার স্বাদ অপরিবর্তনীয় এবং পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু সুরার নহর, পরিশোধিত মধুর নহর এবং সেখানে তাদের জন্যে থাকবে বিবিধ ফলমূল ও তাদের প্রতিপালকের ক্ষমা।

আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহতে বর্ণিত আছে- মহানবী (স.) বলেন, কাউকে যদি দুধ খেতে দেওয়া হয়, সে যেন বলে : হে আল্লাহ আমাদেরকে দয়া করুন ও আরো দুধ দান করুন। কারণ খাবার ও পানীয়ের মধ্যে দুধের মতো আর কিছুই নেই। ইবনুল কাইয়ুম (রা.) তাঁর আল তিব্বুন নাবাবি গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন- ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন : মহানবী (স.)-এর প্রিয় পানীয় ছিল দুধ। যতদূর জানা যায়, মহানবী (স.) প্রতিদিন চার থেকে ছয়টি খেজুর আর ছাগল অথবা উটের দুধ পান করে নাস্তা সারতেন।

দুধ পান করার আদর্শ সময় হচ্ছে সকাল বেলা। তবে দুধের সঙ্গে অন্যান্য চর্বিজাতীয় খাবার অথবা চর্বি জাতীয় খাবারের (যেমন মুরগির মাংস, গরুর মাংস, মাছ) সঙ্গে দুধ না খাওয়াই ভালো। তবে ডিমের সঙ্গে দুধ খাওয়া যেতে পারে। দুধে ভিটামিন এ, বি, বি২, বি১২, সি, ডি, ই থাকলেও ভিটামিন এ ও ডি-এর পরিমাণই বেশি। ডা. হিসাম আল খাতিবের গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে, একমাত্র দুধেই মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির সমস্ত পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। দুধে আছে সুগার, ফ্যাট, মিনারেল, আয়রন, সোডিয়াম, ভিটামিন এ, বি, ডি।

• চর্বি : দুধের মধ্যে থাকা চর্বি বা ফ্যাট গোলাকার ফোটা আকারে উপস্থিত থাকে। এ কারণে দুধের মধ্যে ক্রিমটা সরিয়ে ফেললে দুধের অনেক পুষ্টি উপাদান চলে যায়। কারণ ক্রিমেই চর্বিটা থাকে।

• আমিষ : দুধে দুই ধরনের আমিষ রয়েছে। প্রথমটা হচ্ছে কাসেইনোজেন এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ল্যাকটালবুমিন। এই দু’টি উপাদান দুধের পষ্টি উপাদান অনেক বাড়িয়ে দেয় এবং এ দুটোর আরো বড় পরিচয় হচ্ছে এ দুটোই পূর্ণ আমিষ (প্রোটিন)।

• খনিজ : দুধের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে খনিজগুলো আছে, সেগুলো হলো : সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম।

• ভিটামিন : দুধে সবগুলো ভিটামিনই রয়েছে- এ, বি, বি-২, বি-১২, সি, ডি, ই। তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রয়েছে ভিটামিন এ এবং ডি আর সবচেয়ে কম রয়েছে ভিটামিন সি। তাই দুধের সঙ্গে কমলার রস যোগ করলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যাবে!

• শর্করা : এটি আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায়, যার মাধ্যমে আমরা কর্মঠ ও সচল থাকি।

ইমাম আহমাদ ও আল নাসায়িতে বর্ণিত আছে- মহানবী (স.) বলেন : আল্লাহ সুবহানুতাআলা যে রোগ দিয়েছেন, তার জন্য প্রতিষেধকও দিয়েছেন। তোমাদের উচিত গরুর দুধ পান করা। কারণ গরু সব ধরনের উদ্ভিদ খেয়ে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞানও এটা প্রমাণ করেছে যে, দুধে মানুষের শরীরের জন্য দরকারি সকল পুষ্টিগুণ আছে। বিশেষ করে শিশুদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দুধ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। মহানবী (স.) বলেন, যাদের পেটের রোগ ও উদারাময় আছে, তাদের জন্য উটের দুধে প্রতিষেধক আছে!

আমাদের দেহকে সুস্থ ও সবল রাখতে আদর্শ খাদ্য দুধের তুলনা হয় না। আমরা গৃহপালিত বা খামারে পালিত গরু, ছাগল, মহিষ থেকে সরাসরি সংগৃহীত তরল দুধ কিংবা বিশেষ উপায়ে সংরক্ষিত তরল ও গুঁড়ো দুধ পান করি। জেনে নিন দুধের আরো কিছু গুণাগুণ :

• দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস দাঁতের গঠন ও বিকাশে উপকারী। এটি হাড়ের গঠন ও বিকাশেও খুবই উপকারী।

• সারাদিনের ব্যস্ততার পর ক্লান্তি দূর করতে দারুণ উপকারী একগ্লাস গরম দুধ, যা ক্লান্ত পেশী সতেজ করে। তাছাড়া দুধ খাওয়ার ফলে শরীরে মেলাটনিন ও ট্রাইপটোফ্যান হরমোন নিঃসৃত হয়ে ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে।

• নিয়মিত পাতলা বা কর্ম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

• শরীরে জলশূন্যতা হলে দুর্বল মনোযোগ, স্মরণশক্তির এলোমেলো ভাব, অনুভূতির অবসাদগ্রস্থতা, ভালো না লাগা রোধ করতে নিয়মিত দুধ পান করা উচিত।

• ফল, সবজি আর স্বল্প চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার নিয়মিত গ্রহণ করলে তা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অধিক কার্যকরী।

• দুগ্ধজাত আমিষ শরীরে অ্যামাইনো অ্যাসিড সরবরাহের মাধ্যমে অ্যামাইনো অ্যাসিডের কমতি থাকা সেরিল ও সবজিজাত সাধারণ মানের আমিষের পুষ্টিমান বাড়িয়ে তোলে।

• যারা নিয়মিত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করেন, তারা তুলনামূলক ঝরঝরে শরীরের অধিকারী হন।

• ক্যালরি নিয়ন্ত্রিত সুষম খাবারের অংশ হিসেবে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করলে ওজন হ্রাস ত্বরাম্বিত হয়ে থাকে।

• দুধে প্রচুর পরিমাণে থাকা আমিষ ও Casein, Calcium, phosphorus দাঁতের এনামেলের ওপর প্রতিরোধী পাতলা স্তর গড়ে তোলে ও ক্ষয়রোধ করে।

• দুধে থাকা নানা পুষ্টিগুণ ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।

বুক অফ ফুড এন্ড নিউট্রেশন (১৯৮৯) গ্রন্থে বলা হয়েছে : দুধকে পৃথিবীতে সবেচেয়ে পুষ্টিকর খাবার মনে করা হয়। এটা যেমন সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর শিশুদের জন্য উপযোগী, ঠিক তেমনি মানবশিশুর জন্যও উপযোগী। দুধ কেবল শিশুদেরকেই ভিটামিন সরবরাহ করে না, বরং এটা সকল বয়সী লোকদের জন্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি জুগিয়ে থাকে। ১৯৮৫ সালে বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল the lancet অনুসারে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. গারলেন্ড তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন- যারা প্রতিদিন গড়ে দুই কাপ দুধ খান, তাদের কোলন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়!

আরেকটা কথা মনে রাখবেন- মানবদেহের যে কোনো অঙ্গের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে খাবার গ্রহণ করলে ওই অঙ্গের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হয়। যেমন মানবদেহ দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কালের ওপর। সেই কঙ্কাল বা হাড়ের রঙ সাদা। দুধের রঙও সাদা। সুতরাং দুধ পান করলে হাড়ের ক্ষয় দ্রুত পূরণ করা সম্ভব।

অনেকে অনুযোগ করেন- দুধ পান করলে পেটে গ্যাস হয়। প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠা গরু, ছাগল, মহিষ অথবা উটের দুধ পানে এটা কখনোই ঘটবে না। তবে আজকাল দুধের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অবলা পশুকে নানারকম ওষুধ পানে বাধ্য করা হয়। ফলে প্রাণীজ দুধ তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছে। এ কারণে শারীরিক সমস্যা হলেও হতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা মনস্তাত্ত্বিক।

আদর্শ খাদ্য নির্বাচন ও গ্রহণের ভুলে পাকস্থলিতে এসিডের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। সেই দায় দুধের ওপর চাপানো অনুচিত। যে সকল চিকিৎসক রোগীদেরকে দুধ পানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, অবশ্যই তাঁদের আসলে যথাযথ প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। যত কিছুই হোক না কেন, জীবনভর সুস্থ থাকতে প্রতিদিন এক কাপ/গ্লাস দুধ পান করতে ভুল করবেন না।

Tagged

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.