“স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল” কথাটা প্রবাদতুল্য হলেও সুখী হওয়ার জন্য স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান লোক খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। স্বাস্থ্যবান বলতে আমরা বুঝি, সাধারণত উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মেদহীন শারিরীক গড়ণের অধিকারী।
কিন্তু এছাড়া আরো যে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, সুস্থ্য দেহের সাথে প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ কর্মঠ ব্যক্তিত্বের পরিচয়, যা সুস্থ্যতার অপর নাম। বর্তমান সময়ে নানা ধরণের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। একসময় পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের কিছু নিয়মিত রোগে আক্রান্ত হওয়া ছিল সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে তরুন বয়সীরাও আক্রান্ত হচেছ নানা ধরণের জটিল রোগে । এমনকি শিশুদেরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার নজির মিলছে অহরহ। এর পিছনে কারণ খুঁজলে সহজেই ধরে নেয়া যায়, প্রধানত খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সূত্রপাত।
এটা সত্যি সবাই হয়ত একই কারণে অসুস্থ্য হননা, তবে সাধারণ বিশ্লেষণে এটা প্রমাণিত যে- খাদ্যের নানা অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর উপাদান আমাদের দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা ও স্বাস্থ্যহীনতার অন্যতম কারণ। খাদ্যাভ্যাসের কথা বলতে গেলে এটাই বলতে হয়, যেসব খাবার মূখরোচক ও আকর্ষনীয় হওয়ার কারণে বার বার গ্রহণের তাড়নায় কিছু মানুষ না বুঝেই খেতে অভ্যস্ত হয়। এই আকর্ষণীয় ও মুখরোচক খাবার হিসেবে ফাস্টফুড এখন অনেকের কাছেই প্রথম সারির জায়গা করে নিয়েছে। ঋধংঃ অর্থ দ্রুত। অর্থাৎ দ্রুত যে খাবারটি খেয়ে নেয়া যায়।
ফাস্টফুড আরেক অর্থে জাঙ্কফুড। ঔঁহশ এর আভিধানিক অর্থ লবণাক্ত মাংস অথবা আবর্জনা। সাধারণত যেসব খাবারে ক্যালরি, চর্বি, চিনি, লবণ বেশি থাকে তাদেরকে জাঙ্ক ফুড বলে। বর্তমানে শিশু-তরুণ থেকে বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা ফাস্টফুড তথা জাঙ্কফুডের বিনোদনে আকৃষ্ট হয়ে কারণে-অকারণে নিয়মিত অতিথি হয় ম্যাকডোনাল্ডস, চায়নিজ কিংবা কেএফসি ঘরানার ফুড শপগুলোতে। আমরা প্রায় ভুলেই গেছি-“মানুষ বাঁচার জন্য খাবার গ্রহণ করে, খাওয়ার জন্য বাঁচে না।
”ফাস্টফুড আসলে কি ? এটা এমন একটি খাবার যাতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, উচ্চ শর্করা ও মাত্রাতিরিক্ত লবণ রয়েছে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে কেক-পেস্ট্রি, বিস্কুট, চিপস, পিজা-বার্গার, ফেঞ্চ ফ্রাই, মিষ্টি-ক্যান্ডি চকলেট, আইসক্রিম, বাটার, কনডেন্সডমিল্কসহ প্রক্রিয়াজাত মাংস, কোমল পাণীয় ইত্যাদি। এগুলো দেখতে লোভনীয় ও খেতে মজাদার হলেও এতে শরীরের কোন উপকার হয়না। এতে স্বাস্থ্যকর উপাদান যেমন শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজলবণ খুব কম থাকে। নিয়মিত ফাস্টফুড খেলে শরীরে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভারসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।
ফাস্টফুডকে আকর্ষনীয় করার জন্য অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যাবহার করা হয়। ফাস্টফুডে আয়রণ ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম থাকায় মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাপ্রাপ্তÍ হয়। এসব খাবারের রাসায়নিক উপাদান মস্তিষ্কের নতুন নিউরন সেল তৈরিতে বাধা দেয়।বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে বিগত ৪০ বছরে স্থুলকায় মানুষের হার প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের হার। জাঙ্কফুড উচ্চ ক্যালরিযুক্ত হওয়ায় এতে ওজনাধিক্য, উচ্চ রক্তচাপ এবং শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির কারণ হল চিনি ও তেল।
এ জাতীয় খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। নিয়মিত খেলে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিনিয়ত রক্তে চিনির পরিমাণ ওঠা-নামার ফলে অগ্নাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এতে শরীরের ইনসুলিন নি:সরণের পরিমাণ কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে ডায়াবেটিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়।টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার কথা বলা আছে। এই লক্ষ্য পূরণে সরকার পুষ্টি সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। ২০১৫ সালে প্রণয়ণ করা হয়েছে জাতীয় পুষ্টিনীতি।
এতে বলা হয়েছে, পুষ্টি প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনীয় শারিরীক বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ ও অটুট স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বর্তমানে প্রক্রিয়াজাত ও বাণিজ্যিক খাবারের বিজ্ঞাপণের প্রভাবে স্থুলতা, ডায়াবেটিস ও দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক ব্যাধি মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। একারণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, অতিরিক্ত লবণ, সম্পৃক্ত চর্বি, ট্রান্সফ্রাট পরিহার করে জনগণের আচরণ পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে জাতীয় পুষ্টিনীতিতে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসাব অনুযায়ী বিশে^ প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ট্রান্সফ্যাট গ্রহনের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট।
তাই আগামী প্রজন্মকে অপুষ্টিসহ অসংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করতে হলে পুষ্টি সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে জনগণের পুষ্টিমান উন্নয়নে সুষম খাবার , খাবারের পুষ্টিমান এবং সুস্থতার জন্য কায়িক পরিশ্রম ও শরীরচর্চা বিষয়ে জণসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন বর্তমান সরকার।টেকসই পৃথিবীর জন্য টেকসই মানুষের বিকল্প নেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাস সুস্বাস্থ্যের সাথে সাথে মানুষকে দীর্ঘজীবন উপহার দেয়। সুষম খাবারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হলে পরিবার থেকেই সুস্বাস্থ্যের ধারণা দিতে হবে। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় ঘরে খাবার তৈরিতে সময় দেয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না, জীবনের সকল অর্জনের লক্ষ্যই হলো সুস্থ থাকা।
এটা বাদ দিলে সব অর্জন বৃথা হয়ে যায়। তাই পারিবারিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে সবার আগে। এরজন্য প্রয়োজন পারিবারিক সহমত। ফাস্টফুড কিংবা জাঙ্কফুডের আকর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে এর ক্ষতির দিকটাকে সামনে আনা জরুরি। মায়ের শত ব্যস্ততার মাঝেও শিশুদের ঘরে তৈরি খাবারে আগ্রহী করে তুলতে হবে। খাদ্য তৈরিতে পরিবারের সবার অংশগ্রহণ, বিষয়টাকে সহজ করে তুলবে।
সেইসাথে খাবারের পুষ্টিমান বজায় রাখতে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে। এভাবে আগামী প্রজন্মের মাঝে খাদ্য সচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে কমে আসবে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার ।