পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ : দায়িত্ব কার?
=====================
আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্রেতা বা ভোক্তা। আমরা জনসাধারণ প্রতিদিন বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করি। এসব দ্রব্যসামগ্রী আমরা নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে ক্রয় করে থাকি। আমরা অনেকেই জানি না, বাজার থেকে যেসব দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করছি এসব দ্রব্যসামগ্রীর আদৌ গুণগত ও পরিমাণগত পণ্যের মান সঠিক আছে কি না। বিষয়টি আমাদের আরও ভাবিয়ে তোলে যখন সংবাদপত্রে ‘পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানÑ বিএসটিআইর কোনো মান নেই’ শিরোনামে সংবাদ পড়ি।
এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে, বিশ্বের প্রায় দেশেই ক্রেতা ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কঠোর আইন প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে সে ধরনের কার্যকর কোনো আইন নেই। সংগত কারণেই বাজারে বিক্রেতাদের কাছে ক্রেতারা সবসময় অসহায় বা জিম্মি। বিভিন্ন সংবাদ সূত্রে প্রকাশ, ট্যাং, স্যুপ, মাইলো, হরলিকসসহ নানারকম আমদানিকৃত রেডি ফুড জাতীয় পণ্যসামগ্রী ও তরল পানীয় সামগ্রীতে বাজার ছেয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিজ্ঞাপনের চমক সৃষ্টি করে বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের তুলে দিচ্ছে নানাবিধ জটিল রোগের কোলে। ফলে ক্রেতা কিংবা ভোক্তাশ্রেণি পয়সা দিয়ে রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কোথাও কোথাও মৃত্যুও ঘটছে পাইকারি হারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দীর্ঘদিন থেকে নকল-ভেজাল, মানহীন-গুণহীন পণ্যে বাজার ছেয়ে যাওয়ার বিষয়ে দাবি জানিয়ে এলেও এর প্রতিবিধান হয়নি। উল্লেখ্য, মানহীন পণ্যসামগ্রীর মধ্যে বেশিরভাগ দ্রব্যসামগ্রী রেডি ফুড জাতীয় হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তাশ্রেণি এর গুণাগুণ কিছুতেই যাচাই-বাছাই করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশ ছাড়া এশিয়ার সব দেশেই ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তে আইন আছে, রয়েছে বিশেষ আদালতও। বাংলাদেশের ক্রেতা বা ভোক্তারা ব্যবসায়ীদের চাতুরী, প্রচারণা, সর্বোপরি সংঘবদ্ধতার কাছে জিম্মি। দেশ স্বাধীনের এতটা বছর পরও দেশের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের ব্যবসায়ী, বিশেষ করে অসাধু-দুর্নীতিপরায়ণ কারবারিদের কাছে অসহায়। এটা কিছুতেই স্বাধীন জাতির গৌরবের বিষয় হতে পারে না। এ দুর্বিষহ অব্যবস্থার আশু সমাধান আবশ্যক।
এ কথাও সঠিক যে, দেশে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্য, পণ্যসামগ্রী ও কাঁচামালের গুণগতমান, ওজনমানে নিয়ন্ত্রণকারী বিএসটিআইর পরীক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে না। খাবার পানি, ভোজ্যতেল, তরল খাদ্যসহ মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত প্রায় দেড়শটি পণ্যের ওজন ও গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ করা এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত। জনবলের অভাব দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরঞ্জামের অভাব দেখিয়ে এরা বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। স্থানের অভাব সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিতে নাকি অতিরিক্ত আরও বেশকিছু পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিগত ২৫ বছর ধরে অনেক পণ্যের উৎপাদক একবার প্রতিষ্ঠানটিকে নমুনা দেখিয়ে লাইসেন্স ও প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করে পরবর্তী সময়ে কাক্সিক্ষতমানের পণ্য উৎপাদন না করে, পণ্যের মানের ফলোআপ না করে দেশবাসীকে বঞ্চিত করে চলেছে। এ কথা কে না জানে যে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মান ও গুণাগুণ যথাযথভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার বিকল্প নেই। প্রগতিশীল বাণিজ্যিক বিশ্বে পণ্যদ্রব্যের সঠিক মান-গুণ অটুট রাখতেই হবে। মানুষের পরিবর্তনশীল চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নতমানের ও নতুন নতুন ডিজাইনের নতুন নতুন পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ও জোগান দেওয়ার জন্য দ্রব্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী উৎপাদকরা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে তুমুল বাণিজ্যিক যুদ্ধ। সেখানে গবেষণা বিভাগ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে নতুনত্বের সংযোজন ঘটিয়ে উন্নত মান-গুণ সংরক্ষণপূর্বক নতুন পণ্যদ্রব্য উদ্ভাবন করে, অনেক সময় নতুন উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখার আয়োজনের শেষ নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হচ্ছে, ‘পণ্যের বা সেবার গুণগত মান’ বলতে কোনো জিনিস এ সোনার বাংলায় আছে, এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। লাখ লাখ ক্রেতাকে ওজনে কম, পেট্রল পাম্পে জ্বালানি মাপে কম, খাদ্যে ভেজাল, জীবন রক্ষাকারী ওষুধে ভেজাল, নকল সার, নকল কারখানা, দুই নম্বরকে এক নম্বর বলে চালানো বা এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বর মেশানো এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে ভেজাল আর ভেজালÑ যেন ভেজালের দুনিয়া। পণ্যের গুণাগুণ ও মান শিল্পোন্নয়ন বাণিজ্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
ভোক্তা বা ক্রেতাদের গ্রহণযোগ্য যথোপযুক্ত পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহকরণ নিশ্চিত করতে না পারলে অভ্যন্তরীণ কিংবা বহির্বাণিজ্যের কোনোটিতে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারব না। দ্রব্যের সাইজ, রং, উপযোগিতা, গুণাগুণ, টেকসই ক্ষমতা, সংরক্ষণ, যোগ্যতা ইত্যাদি জাতীয় স্বার্থেই আমাদের বজায় রাখতে হবে। অবাধ বাণিজ্যিক বিশ্বে নির্দিষ্ট মানবিশিষ্ট পণ্য ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে। তাই আমাদের উৎপাদনকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ভোক্তাদের কাছে সব দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্য না হলে তারা বাজার হারাবে। কারণ ভোক্তাই হলো পণ্যদ্রব্যের জীবনীশক্তি। কোনো প্রতিষ্ঠান স্বর্ণের জুতা তৈরি করলেও তা যদি ভোক্তাশ্রেণি ভোগ না করে; তবে সে প্রতিষ্ঠানের মৃত্যু অনিবার্য। পণ্যের গুণগতমান ও সঠিক ওজন নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের দায়দায়িত্ব আরও বেশি। আমাদের আফসোস, প্রতিটি সরকারই এ বিষয়টি কৌশলে কেন যে এড়িয়ে চলে, তা বোধগম্য নয়। এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে, ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রতিটি সরকারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি পণ্যদ্রব্যের প্রতি ভোক্তাশ্রেণি একদিকে যেমন আকৃষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশি পণ্যদ্রব্যে বাজার সয়লার হয়ে যাচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হচ্ছে জাতির ভাগ্য। কোনো কাজই যেন শেষ হয়েও হয় না। এখানে তেলের দাম আর ঘিয়ের দাম একই। বলা বাহুল্য, যে দেশের তেলের দাম আর ঘিয়ের দাম সমান, বুঝে নিতে হবে সে দেশের শাসন, প্রশাসন, বিচার, আইন, সরকার ও ব্যবস্থাপনায় যোগ্য ব্যক্তির পদচারণা নেই। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেমন ঝুলে থাকে, অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। স্বাস্থ্যবান লোক দেশ ও জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। খাদ্যে ও বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে এ দেশের বিশাল মানবসম্পদকে শারীরিক, মানসিক ও দৈহিকভাবে নষ্ট করার যে হীন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছেÑ এর ভিত এখনই মচকে-ভেঙে ফেলার উৎকৃষ্ট সময় ও সুযোগ। গরিব রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের আয়োজনে সীমাবদ্ধতা থাকবেই। আমাদের আরজÑ এতে আমাদের ঐকান্তিকতা, আন্তরিকতা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা সর্বোপরি দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও জবাবদিহিতার তো কমতি থাকার কথা নয়। দেশের জনগণকে মানসম্পন্ন পণ্যদ্রব্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।
স্টাফ রিপোটারঃওমর ফারুক